বৃষ্টি হচ্ছে একটানা অনেকক্ষণ। সবুজ পাতা, ডাল, কাণ্ডসহ আমার গোটা গায়ে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় বৃষ্টি। কয়েকটি কাক আমার উঁচু নরম ডালগুলিতে বসে ডানা ঝাপটে তাদের গায়ের পানি সরানোয় ব্যস্ত, কিছুক্ষণ পরে ওরা আবার অন্য ডালে যেয়ে ভারসাম্য রক্ষা করছে। আমার একপাশে লেকের টলটলে পানি ধীরস্থির গাম্ভীর্যে নদীর মতো অবয়ব নিয়ে বয়ে যায়, এই লেক আর চারপাশের সৌন্দর্য আমাকে ঈর্ষান্বিত করে। আমার দু’একটা পাতা লেকের পানিতে পড়ে হাবুডুবু খায়।
মানুষ বিকেলে লেকের তীরে বসে গল্প করে, মজা করে, হাঁটা-হাঁটি করে তাও ভালো লাগে। অন্যপাশে একটা সাধারণ বাড়ি কিন্তু কেন জানি অসাধারণ। এই বাড়িটা হওয়ার পর থেকে সবসময় এখানে লোক আসা-যাওয়া করে। বাংলাদেশ হওয়ার আগে এখানে কত সাধারণ মানুষ, কত নেতা কর্মী, কত ছাত্র জনতা দেখেছি। সকলের মাঝে লক্ষ্য করেছি কত আবেগ কত উৎকন্ঠা, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত। একাত্তর এর অগ্নিঝরা মার্চে বাড়ির সামনে জনতা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা টানিয়ে দেয়, সবুজের মধ্যে লাল আর লালের মধ্যে হলুদ বাংলাদেশের ভূখণ্ড। কি সুন্দর পতাকা চোখে পানি এসে যায়, মনে হয় সারা বাংলার প্রতিচ্ছবি এতে আঁকা। একসময় আমার মনে হতো এই বাড়িটাই কি বাংলাদেশ?
তবে একদিন আমি ভীষণভাবে চমকে গেলাম, বিস্মিত হলাম। কয়েকজন মানুষ বাড়িটাকে পুড়িয়ে দিল, পুরো স্হাপনাকে বুলডোজার না কি যেন নাম তা দিয়ে ধ্বংস করে দিল। তারা কি সত্যিই মানুষ ছিল? আচ্ছা ওরা কি জানে একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের বাড়ির ঠিকানা ঐ বাড়িটা? ঠিকই জানে কিন্তু না জানার ভান করে। আগুনের লেলিহান শিখায় বাড়িটা পুড়তে দেখে হঠাৎ একটা সত্যের মুখোমুখি হলাম তবে এটা একান্তই আমার নিজস্ব ভাবনা। মাটির উপরে আমার যে শরীর দাঁড়িয়ে আছে সেটা বেশ শক্ত। মানুষের শরীরটা আমার মতো শক্ত নয় তবে কেন জানি মনে হয় আমার ভিতরটা মানুষের মনের চেয়েও অনেক বেশি নরম, কম নির্দয়, কম কৃতঘ্ন।