বীর প্রতীক ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম

ডা. সিতারা বেগম

বীর প্রতীক ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য নাম। তিনি শুধু একজন চিকিৎসকই নন, ছিলেন এক সাহসী যোদ্ধা, যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের সেবা করেছেন। চিকিৎসা শপথকে তিনি রূপ দিয়েছিলেন দেশপ্রেমে। তাঁর অবদান প্রমাণ করে যে স্বাধীনতার লড়াই শুধু অস্ত্র হাতে নয়, মানবিক দায়িত্ব পালনেও সম্ভব।

ডা. সিতারা বেগম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, কিশোরগঞ্জ জেলায়। তাঁর পিতা ইসরাইল মিয়া ছিলেন একজন আইনজীবী। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ও দায়িত্বশীল ছিলেন।

তিনি ঢাকার হলি ক্রস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরে কমিশনপ্রাপ্ত হন এবং লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন। সেখান থেকেই তাঁর চিকিৎসা ও সামরিক জীবনের সূচনা হয়।

১৯৭১ সালের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সিতারা বেগম দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন- তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করবেন। সেই সময় তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে স্থাপিত বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল-এ যোগ দেন।

এই হাসপাতালটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার প্রধান কেন্দ্র। প্রাথমিকভাবে হাসপাতালটিতে প্রায় ২০০টি শয্যা ছিল, পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪০০ শয্যায় উন্নীত হয়। এখানে প্রতিদিন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শত শত আহত মুক্তিযোদ্ধা আসতেন চিকিৎসার জন্য।

ডা. সিতারা বেগমকে শিগগিরই হাসপাতালের কম্যান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সীমিত যন্ত্রপাতি, কম ঔষধ, বিদ্যুতের ঘাটতি ও নিরবচ্ছিন্ন চাপের মধ্যেও তিনি দিনরাত কাজ চালিয়ে যান।

তিনি প্রায়ই একটানা রাতভর অপারেশন করতেন, নিজ হাতে ব্যান্ডেজ দিতেন, আহতদের পাশে বসে সাহস জোগাতেন। শুধু চিকিৎসক নয়, তিনি একজন প্রশাসক ও সংগঠক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন- চিকিৎসা দল পরিচালনা, সরঞ্জাম সংগ্রহ, খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করা, এমনকি আহত যোদ্ধাদের মানসিক সান্ত্বনা দেওয়াও ছিল তাঁর কাজের অংশ।

ডা. সিতারা বেগমের নেতৃত্বেই সেই হাসপাতালটি যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। বিজয়ের পরও তিনি থেকে যান আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায়, যতদিন না সবাই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেন।

স্বাধীনতা অর্জনের পর ডা. সিতারা বেগম বাংলাদেশে ফিরে আসেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অভ্যুত্থানের সময় তিনি ভয়াবহ এক ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হন- তাঁর ভাই মেজর এ.টি.এম. হায়দার ৭ নভেম্বরের ঘটনার সময় নিহত হন।

এই ঘটনার পর পারিবারিক ও নিরাপত্তাগত কারণে তিনি দেশত্যাগ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানেও তিনি চিকিৎসা পেশায় যুক্ত ছিলেন এবং মাঝে মাঝে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নিতেন।

ডা. সিতারা বেগমের অসামান্য সাহস, দায়িত্ববোধ ও মানবিক অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে “বীর প্রতীক” খেতাবে ভূষিত করে। এটি দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক পুরস্কার।

তিনি বাংলাদেশের অল্প কয়েকজন নারী মুক্তিযোদ্ধার একজন যিনি এ সম্মান লাভ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

বীর প্রতীক ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা বেগম শুধু একজন চিকিৎসক নন- তিনি এক অনুপ্রেরণার নাম। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, দেশপ্রেম শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, সেবা, দায়িত্ব ও মানবতার মধ্য দিয়েও প্রকাশ করা যায়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে তাঁর নাম আরও বিস্তৃতভাবে প্রচার ও স্বীকৃত হওয়া উচিত। কারণ, তিনি আমাদের দেখিয়েছেন- একজন নারীও দেশের জন্য বীর হতে পারে, এক টুকরো কাপড় দিয়ে ক্ষত বেঁধেও স্বাধীনতার পতাকা তুলে ধরতে পারে।